খুলনা, বাংলাদেশ | ৩রা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৬ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাছাই: স্কটল্যান্ডকে ৩৪ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ
  জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক হুইপ ও খুলনা-১ সাবেক সংসদ সদস্য পঞ্চানন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
  ১১৮ বারের মত পেছালো সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার প্রতিবেদন

হিন্দু মুসলমানের ধর্ম আত্মীয়তা

এ এম কামরুল ইসলাম

ছোটবেলায় আমার দাদীর সাথে সওয়ারি হয়ে বহুবার আমাদের পাশের গ্রামের গৌর হালদারের বাড়িতে গিয়েছি। তাদের দোতলা বাড়ি ছিল। সেই বাড়ির উঠোনে একটা বিশাল সফেদা গাছ ছিল। আমার জীবনে প্রথম দেখা ছোট ছোট অথচ অসাধারণ মিষ্টি জাতের সফেদা আমি তার আগে কখনো খাইনি। তাদের বাড়ির পিছনে লাল জামরুল গাছটার কথা আমার আজো মনে পড়ে। আমার দাদার আমল থেকে ঐ বাড়ির সাথে আমাদের ধর্ম আত্মীয়তা ছিল।

দেশ স্বাধীনের আগের কথা বলছি। ঐ আমলে আমার দাদা ও গৌর হালদারে বাড়িতে দোতালা দালান ছিল। তাছাড়া সমগ্র এলাকায় হাতে গোনা দু’একটা দোতালা দালান ছিল। আমার দাদাকে আমি দেখিনি। কিন্তু দাদীর অনেক কথা আমার ভালভাবে মনে আছে। আমাদের বাড়িতে কোন বিয়ে সাদী বা অনুষ্ঠান হলে গৌর হালদারের বাড়িতে দাওয়াত দিতে ভুল হলেই দাদী মন খারাপ করতেন। বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। মুখ খুলে আমার বাবা চাচাদের তেমন কিছু বলতেন না। তার নিজের মেয়ে জামাইদের দাওয়াত করার খোঁজ খবর না নিলেও গৌর হালদারের বাড়িতে সওয়ারী আনতে পাঠানো হয়েছে কিনা তা নিজেই তদারকি করতেন। এই কাজে কোন বিলম্ব বা গাফিলতি দেখলেই তিনি বলতেন- তোরা কি তোদের বাপের গড়া সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলবি?

আমার বাবা চাচারা দাদীকে ভীষণ মান্য করতেন। তাই আমার বাড়ির সকল অনুষ্ঠানের আগেই গৌর হালদারের বাড়িতে সওয়ারী আনতে যেতে হতো। আমি বয়সে ছোট হওয়ায় আমার বড় ভাইয়েরা সওয়ারি আনার দায়িত্ব পেতেন। আমিও মাঝে মাঝে এই দায়িত্ব পালন করতাম। তবে গৌর হালদারের বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে দাদীর সাথে সওয়ারী হতে ছোটদের অগ্রাধিকার থাকতো।

আমার দাদীকে কখনো রান্নাঘরে খাবার খেতে দেখিনি। আমার দাদার বিশাল দোতালায় তাঁর জন্য নির্ধারিত ঘর ছিল। সেই ঘরে তিনি থাকতেন। গৌর হালদারের বাড়িতে সওয়ারী হয়ে গেলেও তাঁকে দোতালায় থাকার ব্যবস্থা করতেন। দাদীর পানের বাটা ও পান বাটার হামানদিস্তা সাথে নিয়ে যেতেন।  তাঁর সেই হামানদিস্তায় পান সুপারী বাটার শব্দ আমার এখনো কানে বাজে। দাদীর হামানদিস্তার শব্দ পেলেই আমরা দোতালায় দৌঁড়ে গিয়ে ভীড় করতাম। দাদী হামানদিস্তা থেকে লাল টুকটুকে বাটা পান সুপারি আঙুল দিয়ে আমাদের হাতে দিতেন। আমরা মহা খুশিতে সেই পান সুপারি মুখে নিয়ে কার ঠোঁট কত লাল হয়েছে সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তাম। দাদী যখন গৌর হালদারের বাড়িতে সওয়ারী থাকতেন তখনো ঐ বাড়ির শিশুদের পান সুপারি বাটা দিতেন। আমাদের বাড়ির শিশুদের ও গৌর হালদারের বাড়ির শিশুদের একই দৃষ্টিতে দেখতেন।

আমার দাদীর সাথে ঐ বাড়িতে যেতে আমি মাঝে মাঝে আপত্তি করতাম। কারণ ঐ বাড়ির পাশে বিশাল একটা সমাধি ছিল। ঐ সমাধিতে গৌর হালদারের বাবাকে মৃত্যুর পর লবন দিয়ে রাখা হয়েছিল বলে জানতাম। আবার সেই সমাধির পাশে ছিল বিশাল এক বটগাছ। ঐ গাছে ভুত থাকতো বলে ছোটবেলায় শুনতাম। তাই দাদীর সাথে ঐ বাড়িতে যেতে চাইতাম না। কিন্তু আমার দাদীর হুকুম অমান্য করলে আমার বাবা কাউকে ছেড়ে দিতেন না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদীর সাথে ঐ বাড়িতে বহুবার গিয়েছি।

বিল ডাকাতিয়ার পাশে আমাদের গ্রাম ও গৌর হালদারের গ্রামের মাঝামাঝি আমার দাদার কয়েক বিঘার খেজুর বাগান ছিল। সেই খেজুর বাগান আমাদের এলাকায় ‘বুচতলা’নামে পরিচিত। ওখানে একটি বিশাল বটগাছ ছিল। এলাকার সকল হিন্দু ওখানে চৈত্র সংক্রান্তির দিন পুজো করতে আসতো। আমরাও একইভাবে সেই পুজোয় যেতাম। সেখানে আমাদের খেজুর গাছে হিন্দুদের খেজুর ভাঙার উৎসব হতো। হিন্দু মুসলমান সবাই একসাথে সেই উৎসব উপভোগ করতাম।

তারপর শুরু হলো স্বাধীনতা আন্দোলন। রংপুরের প্রফুল্ল বাবুসহ কয়েকজনকে পাক সেনারা গুলি করে মেরে গেল। মুজোরঘুটো, বসুরাবাদে লখাই ডাকাত, রাজ্জাক ডাকতের দল ঘাটি গেড়ে লুটপাট শুরু করলো। একরাতে আমাদের এলাকার কিছু সাহসী মুসলমান ও ঐ এলাকার হিন্দুরা একত্রিত হয়ে ডাকাত দলের কয়েকজনকে জবাই করে মেরে ফেললো। পরদিন সকালে আমরা দলে দলে সেখানে গিয়ে দেখলাম – আমার চাচা আবদুল গফুর আকুন্জী তাঁর লাইসেন্সধারী বন্দুক কাঁধে নিয়ে হিন্দুদের রক্ষা করার ও সাহস যোগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তবুও শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে রাতারাতি সকল হিন্দু ভারতে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন।

রাতের অন্ধকারে গৌর হালদারের বাড়ির সকল নারীপুরুষ আমাদের বাড়িতে এলেন। সাথে কৃষ্ণনগর থেকে অনেক মানুষ এসেছিল। তারা আমার দাদীকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে করতে তাদের বাড়িটি রক্ষার জন্য অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন। কেউ কেউ আমাদের বাড়িতে তাদের সখের গরু রেখে গেলেন। আমার দাদী নিরুপায় হয়ে গৌর হালদারের বাড়ি রক্ষা করার জন্য সেখানে থাকতে রাজি হলেন। তারা ভারতে যাওয়ার সময় আমার কয়েকজন বড় ভাই তাদের সাথে ভারতে চলে গেল। আমার বাবা দাদীর সাথে আমাকে গৌর হালদারের দোতালায় রেখে এলেন। দিনরাত গা ছমছম করা অবস্থায় আমরা সেই বাড়িতে থাকতাম। দিনে ও রাতে কয়েকবার আমার বাবা চাচারা আমাদের খাবার দিয়ে আসতেন।

এভাবে কয়েকদিন চলে গেল। হঠাৎ একদিন নকশালপন্থীরা ঐ গ্রামের সকল বাড়িতে ক্যাম্প করতে শুরু করলো। আমাদেরকে বাড়ি ছাড়ার হুকুম দিলো। একদিন আমার বাবা গিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলেন।

এরপর দেশ স্বাধীন হলো। গৌর হালদারের পরিবার দেশে ফিরে প্রথমেই আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। দাদীকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার বাবার নিহত হওয়ার খবর তারা আগেই পেয়েছিলেন। দাদীর কাছে তাদের কোন মূল্যবান কিছু আমানত ছিল কিনা তা আমি জানতাম না। তবে তাদেরকে গোপনে আলোচনা করতে দেখেছি বহুবার। আমাদের বাড়িতে হেফাজতে রেখে যাওয়া সকল গরু প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়া হলো।

দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর আমার দাদী ইন্তেকাল করেন। আমার বাবাও নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু আমার মা জীবিত থাকাকালীন আমাদের বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে গৌর হালদারের বাড়িতে দাওয়াত দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলতেন- আমার শ্বশুরের গড়া সম্পর্ক তোরা কখনো নষ্ট করবি না। তাতে আমার শ্বশুরের আত্মা কষ্ট পাবে।

সময়ের পরিক্রমায় সেই সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠানে তাদের বাড়ির সওয়ারী, আর তাদের বাড়ির অনুষ্ঠানে আমাদের বাড়ির সওয়ারীর আনা নেওয়া আজকাল আর হয় না। বড়জোর কালেভদ্রে মনে হলে দুই বাড়ির দাওয়াত দেওয়া নেওয়া এখনো কোনমতে টিকে আছে।

দেশের হালচাল বদলাতে শুরু হয়েছে। বৈশ্বিক ও দেশের রাজনীতির বেহাল দশায় সেই মধুর সম্পর্কে ঘূণ লেগেছে। দিন দিন পরস্পরের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই সম্পর্ক কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে আমি শঙ্কিত। তবুও নববর্ষের মহিমায় হিন্দু মুসলমান পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখুক এই কামনা করি।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!